 |
জারগেন হেবারমাস(১৯৭০-১৯৮০)
|
©® ফারহিন ভূঁইয়া ন্যান্সি।
ভূমিকাঃজারগেন হেবারমাস গত দশকের (১৯৭০-১৯৮০) একজন খ্যাতনামা জার্মান সমাজবিজ্ঞানী যিনি তাঁর মননশীল পদচারণা বিস্তার করেছেন সুদুর দর্শনশাস্ত্র হতে সমাজবিজ্ঞানে। সমাজবিজ্ঞানের ক্রিটিকাল থিওরিতে তিনি সংযোজন করেন নতুন মাত্রা সেই সাথে ঐতিহাসিক ভাববাদকে জ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এক অতীব জরুরি উপাদান হিসেবে দাঁড় করিয়ে তিনি মানব চাহিদা ও তদানিন্তন জ্ঞানের বিকাশের ভুমিকা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর চিন্তাভাবনার শেকড় জার্মান কান্তীয় হতে মার্ক্সীয় পরম্পরায় গ্রথিত। তিনি, ফ্রাংকফুর্ট স্কুলের সাথেও সন্নিবেশিত ভাবে জড়িত ছিলেন যারা মার্ক্সবাদকে ফ্রয়েডবাদের সাথে মেলান। সেখানে হেবারমাস তাঁর নব নব তত্ত্ব যেমন জ্ঞানের সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা যা নিরপেক্ষ নয় বরং, মানুষের চাহিদা ও কর্মের সাথে সম্পৃক্ত, সিস্টেম এবং লাইফওয়ার্ল্ড, উদ্দেশ্যমূলক এবং সংযোগমূলক কর্ম, আধুনিকতার উদ্ভব ও বিকাশ এবং বিবর্তন, প্রমুখ নিয়ে আলোচনা করেন।
আলোচিত প্রবন্ধে আমরা হেবারমাসের জ্ঞানের সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের বিশদ বিশ্লেষণ করব সমসাময়িক সমাজের প্রেক্ষাপটে। হেবারমাস দেখিয়েছেন যে এনলাইটেনমেন্ট আসলে সুফল নিয়ে এসেছিল তার চেয়ে বেশি শোষণ ও অবদমন নিয়ে এসেছিল। অর্থাৎ, এনলাইন্টেনমেন্ট প্রক্রিয়াটিও কিন্তু দোষমুক্ত নয়, বরং একে এর সমস্ত দোষ-গুন সার সত্তা নিয়ে গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে এনলাইটেনমেন্টের ফলে যে নতুন উপদ্রবের সৃষ্টি হয়েছে তাকে সংশোধন করার জন্যে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ, এনলাইটেনমেন্ট যে প্রকৃত মুক্তি তথা পরম স্বাধীনতার কথা বলে, সেই পরম মুক্তি বা স্বাধীনতার উপায় অর্জন করা। এনলাইটেনমেন্ট যেটি কিনা ইন্সট্রামেন্টাল রেশনালিটি বা যান্ত্রিক অপ্রমত্ততাকে নির্দেশ করে, সেটির পরিবর্তে উনি কমিউনিকেটিভ রেশনালিটি বা সংযোগমূলক যুক্তিকে বুঝিয়েছেন। কারন, মানুষ আসলে ভাষার মাধ্যমে জীবন ও জগতের সাথে ভাব বিনিময় করে আর ভাষার মাধ্যমেই পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় জড়িত হয়ে বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন করে৷ কারন, একজন স্বাধীন ব্যক্তি মাত্র অপর স্বাধীন ব্যক্তির সাথে ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে যার জন্যে তিনি বলতে বাধ্য হোন যে জ্ঞান আসলে নিরপেক্ষ নয় বরং, তা ঐতিহাসিক এবং সমস্ত মানবসত্তার কলেবর জুড়ে বিস্তারিত। তাই, হেবারমাস বলেন প্রকৃতপক্ষে কোনো জ্ঞানই মানুষের সংস্পর্শের বাইরে নয়, কোনো জ্ঞানই মানব চাহিদার বাইরে নয়। মানুষ আকাঙ্খা করে তাই সে জ্ঞান অর্জন করে বিভিন্ন চাহিদার মুখাপেক্ষী হয়ে। চাহিদা একক নয় এবং বহুতরো। তাই, চাহিদার রকমফেরের জন্যে জ্ঞানেরও ভেদাভেদ হয় এবং একেকজন একেক রকম জ্ঞানে দীক্ষিত হয়ে একটি বহুমুখী সমাজ গঠন করে। এই বহুমুখী সমাজে, বিভিন্ন চাহিদার সংঘর্ষে বিভিন্ন জ্ঞান ও ভাববাদের জন্ম হয় যা নিদেনপক্ষে একমাত্রিক সমাজকে বহুমাত্রিক করে তুলে। যার ফলে,সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে নানান মতাদর্শে। আমরা যদি, বর্তমান সময়ে আলোকপাত করি তবে দেখব হেবারমাস যেভাবে দেখিয়েছেন, যে সমাজে শোষণের মাত্রাতিরিক্ত থাকে সেই সমাজ মুক্তির জন্যে উপায় খুঁজতে থাকে। এক নতুন জ্ঞানের উদ্ভব হয়। তেমনি, আমরা যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের অবস্থা পর্যালোচনা করি, তবে সেখানেও একই সত্য অবলোকন করব যে, কিভাবে শোষিতরা মুক্তির জন্যে আন্দোলন করছে, স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করছে এবং তাদের মধ্যে সামগ্রিকভাবে একটা নব চেতনা জাগ্রত হয়েছে যা তাদেরকে তাদের পূর্ববর্তী চাহিদা ও ভ্রমের ভাববাদ থেকে বের করে এনে নতুন ভাবে নতুন সত্ত্বা ও নতুন বিশ্বাসে পুনরুজ্জীবিত করেছে। উক্ত প্রবন্ধে, আমরা হেবারমাসের জ্ঞানের সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব দিয়ে দেখাব বর্তমান সমাজে কেন জ্ঞানের সঠিক বিকাশ হচ্ছে না, কেন বিভিন্নমুখী চাহিদার বশবর্তী হয়ে মানুষ প্রকৃত জ্ঞানে দীক্ষিত হচ্ছে না, যার জন্যে মানবমুক্তির পরম সীমায় পৌছাতে পারছে না বরং নিত্যনতুন শৃঙখলে আবদ্ধ হয়ে জঞ্জালে পরিণত হচ্ছে। কেন, সঠিক, সুন্দর ও সত্য জ্ঞানের বিকাশ ঘটছে না যা সমাজকে বন্ধনমুক্ত করবে, বিকশিত ও এক নতুন ধারায় বিবর্তিত করবে। সেই সাথে আমরা বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর দিয়ে আলোকপাত করে দেখব যে, আদতে কি মানব চাহিদার বহুমুখীতার জন্যে জ্ঞানের সঠিক বিস্তার হচ্ছে না, এবং মানুষ চিরাচরিত নিয়মে এক অদৃশ্য কারাগারে বন্ধী হচ্ছে যা অবদমন ও ভ্রমের মাধ্যমে তার বিশ্বাসকে সংকীর্ণ করে তাকে পরাধীন করে রাখছে কিনা। আমরা দেখব, হেবারমাসের আলোকে সমাজ কেন এত অধঃপতিত হচ্ছে এবং প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তিরা কেন সমাজে পরম মুক্তি বা স্বাধীনতার পথ উন্মোচন করতে পারছেন না বা মশাল ধারণ করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না অথবা দেয়া হচ্ছে না। অতএব, বলা বাহুল্য যে হেবারমাসের জ্ঞানের সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ এবং সমসাময়িক বিষয়াদিতে প্রাসঙ্গিক।
(চলবে)
Comments