উত্তরাধুনিক সমাজে সাহিত্য শিল্পের প্রয়োজনীয়তা।
উত্তরাধুনিক সমাজে শিল্প সাহিত্যের প্রয়োজন আকাশচুম্বী। কারন, এই সময়ে মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে আরো বিচ্ছিন্নতরো হইতে থাকে, পরিবার থেকে, ব্যক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা থেকে, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিমন্ডল হতে, অর্থনৈতিক কর্মসংস্থান হতে, বন্ধুত্ব ও ব্যক্তিক সম্পর্ক গুলো হতে। ব্যক্তি মাত্রই নিঃসঙ্গ আর বিচ্ছিন্ন। সে হতাশ হয়ে যায় অল্পতে। কারন, সে একটা নিরাশ আর ভঙ্গুর সমাজে বেড়ে উঠেছে। সবসময় বিচ্ছিন্নতা আর টিকে থাকার লড়াই দেখেছে। তার উপর, আধুনিক সমাজে সবাই এত ব্যস্ত আর কারণিক, কার্যকারণ নির্ভরশীল ও অর্থনৈতিকভাবে চিন্তাভাবনা করে এবং স্বার্থকেন্দ্রিক সম্পর্কগুলো টেকসই হয় কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবদ্ধ নিয়মকানুনের জন্য, ফলত সামাজিক সম্পর্কগুলো ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ব্যক্তির একান্ত আশ্রয়স্থল খুবই কম থাকে। তাহলে, ব্যক্তির কাছে কি থাকে?! ব্যক্তির কাছে ব্যক্তির ব্যক্তিক জীবন ছাড়া আর কিছুই থাকে না। অর্থাৎ, সে নিজেই নিজের সম্বল হয়ে উঠে। তাই, উত্তরাধুনিক সমাজে ব্যক্তি সরাসরি কোনো মানুশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন না করে, বিচ্ছিন্ন ভাবে সময় কাটায় ডিজিটাল প্লাটফর্মে। কারন, সে জানে মানুষ তাকে নিরাশ করবে। এজন্যে, সে বেশি বেশি নিমগ্ন থাকে নেটফ্লিক্স, হইচই,এমাজন, পাবজি, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবের ডিলিউশনাল ভ্রান্ত জগতে। সেখানে সে নিজের একটা আলাদা জগত তৈরি করে নেয়। এজন্যে, এই সময়ে উৎকৃষ্ট মানের শিল্প, সাহিত্য,কবিতা, নাটক, সিরিজ তৈরি করা সময়ের দাবী হয়ে গেছে। কারন, ব্যক্তি এখন এসব জায়গা থেকেই মানুশ ও মনুষ্য জগত সম্পর্কে পাঠ নিচ্ছে।ব্যক্তি, যেন ভালো কিছু শিখতে পারে, সমাজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পায়, নিছক বিনোদনের নামে অথবা একাকিত্ব কাটানোর উপায় হিসেবে এসব প্লাটফর্ম ব্যবহার না করে তার জন্যে, সত্যিকারের আর্টের প্রয়োজন এখন আগের চেয়েও বেশি। আর তাছাড়াও, কর্মজীবী ব্যস্ত মানুষরা যখন কাজ করতে করতে বিচ্ছিন্নতাবোধ করেন, তখন তাদের অবকাশ হিসেবেও এই ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলো ভূমিকা পালন করে, কারন এখন পর্যটন আর ব্যক্তিক সম্পর্কগুলো খুবই ব্যয়বহুল, স্বার্থান্বেষী আর হতাশাব্যঞ্জক হয়ে গেছে। ব্যক্তি চাইলেই আর সমুদ্র পাড়ে ঘুরে আসতে পারছে না ভীড়, জ্যাম, ঠেলে। চাইলেই, প্রিয়জনকে নিয়ে দূরে কোথাও নিরিবিলি ভ্রমনে যেতে পারছে না মুদ্রাস্ফীতির জন্য দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতির কারনে যেখানে ব্যক্তি নিজের জীবন একটা মোটামুটি মানে চালাতে ব্যর্থ হয় সেখানে ভ্রমণ বা সুষ্ঠ বিনোদনের চিন্তা করাটা বিলাসিতা। অথবা প্রিয়জন না থাকার অভাবে বা এমনও হতে পারে, প্রিয়জন আর প্রিয় এর কাঁতারে থাকে না বিধায়, ব্যক্তিও নিজেকে আর চিনতে পারে না। আর তাছাড়াও, উত্তরাধুনিক সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাসের চরম অবনতি ঘটে, যার জন্য বৃহত্তর সমাজে, মানুষে মানুষের মধ্যে সংহতি কম বা যদি থাকেও, তা লেনদেন ভিত্তিক ও সাময়িক। বিচ্ছিন্ন হতে হতে ব্যক্তি নিজেই নিজের ব্যক্তিক সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। তাই, অবসর বা অবকাশ বা সাময়িক বিরতি যাই বলা হোক না কেন ব্যক্তিকে ফিরে আসতে হয়, কবিতা,গল্প, উপন্যাশ, গান, সিনেমা, নাটকের কাছে। তাই, এসব শিল্প সাহিত্যও আসলেও মনের খোঁরাক জাগানিয়া সত্যিকারের শিল্প হওয়া চাই, যেন এখানে এসেও ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন না হয়। যেন, অন্তত শিল্প সাহিত্যের সাথে ব্যক্তি নিজেকে মেলাতে পারে, একটা সহয যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে। যেন, এখানে ব্যক্তি একটা 'ইস্কেপ' খুঁজে পায়। জীবনের অর্থ নতুন করে যেন বুঝতে পারে। সাহিত্যের সাথে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির যেন একটা সহয কিন্তু নান্দনিক সুন্দর সম্পর্ক রচিত হয়।
©® ফারহিন ভুঁইয়া ন্যান্সি
Comments